১৪ মে, ২০১৩

প্রবন্ধ - সুদীপ নাথ

পরিবার প্রথার বিবর্তন
সুদীপ নাথ


১৫মে-আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ১৯৯৩ সালে গৃহীত এক প্রস্তাব অনুযায়ী এই দিবসটি পরিবার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক পরিবার দিবসের বিষয়টি সাধারণ ভাবে ব্যাপক জনপ্রিয় না হলেও সমাজের মৌলিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে এর গুরুত্ব অপরিসীম।

নরনারীর সম্পর্ক নিয়েই গড়ে উঠে পরিবার। সুদূর অতীতে পরিবার গড়ে উঠেছিল রক্তের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে। এখন আমরা ভাবতেও লজ্জা বোধ করি যে, আমাদের পুর্ব পুরুষেরা যখন পরিবার প্রথা চালু করেছিল; তার আগে নরনারীর যৌন সম্পর্ক ছিল নির্বিচার। তা অবিশ্যি বন্যাবস্থার নিম্নতম স্তর হিসেবেই চিহ্নিত। এই পর্ব সম্ভবত সাত হাজার বছর ধরে চলেছিল। এর কোনও প্রমাণ কিন্তু আমাদের হাতে নেই। তবে পশু থেকে মানুষে উত্তরণের প্রক্রিয়াতে এমন একটি স্তর ছিলনা মেনে নেয়া যায় না।
এদিকে, আত্মীয়তা বিধি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সমস্ত আত্মীয়তা সম্পর্কের পেছনেই রয়েছে কোন না কোন একজোড়া নারী ও পুরুষের যৌন সম্পর্ক। কথাটা শুনতে খটমট লাগলেও, একটু মাথা ঠান্ডা করে ভেবে দেখুন তো বিষয়টা। মা বাবার যৌন সম্পর্কের জেরেই ভাই-বোন সম্পর্কের উৎপত্তি। নারীপুরুষের বিয়ে হওয়ার সাথে সাথেই শ্বশুর ও শাশুড়ি নামে আত্মীয়তার প্রশ্ন উঠে। মামা, মাসির সাথে আমাদের সম্পর্কটাও মা বাবার বৈবাহিক সম্পর্কেরই জের।

সমাজের পরিবর্তন, ক্রমবিকাশ ও বিবর্তনের হাত ধরে, সমস্ত বিশ্ব জুড়ে পরিবার প্রথারও বার বার পরিবর্তন হয়েছে। এটা ঐতিহাসিক কারণেই ঘটেছে। এখন আধুনিক সমাজে পরিবারের যে বিশেষ রূপটি চোখে পড়ে, তা হচ্ছে একপতপত্নী পরিবার। বর্তমানে এই একপতপত্নী প্রথা কিন্তু সব মানব গোষ্ঠীতেই যে বিদ্যমান তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন মানব গোষ্ঠীতে এখনও পুরনো ধাঁচের বিভিন্ন পরিবার প্রথা দেখা যায়। তবে তা দ্রুতলয়ে পাল্টে যাচ্ছে, সমাজ পরিবর্তনের সাথে সঙ্গতি রেখে।

বাঙালি সমাজে বর্তমানে বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবীই অতীত এবং বর্তমানের বিভিন্ন পরিবার প্রথার মৌলিক রূপটি দেখতে রাজি নন। তারা মাতৃতান্ত্রিক ও পিতৃতান্ত্রিক – এই দুটি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই হাবুডুবু খান। তারা বর্তমানের পুরুষ শাসিত সমাজ তথা পুরুষাধিপত্যের বিষয় নিয়েই মাতামাতি করেন, কিন্তু বর্তমান পারিবারিক রূপটির অন্তর্নিহিত এবং মৌলিক গঠনের সামাজিক বিচার বিশ্লেষণে যান না। তারা বর্তমানের রূপটির মধ্যেই, পুরুষ কর্তৃক নারী নিপীড়ন বন্ধ করার জন্য কঠোর সমালোচকের ভূমিকা নেন, কিন্তু পরিবারের ভিতরের মৌলিক আন্তঃসম্পর্কের বিচার বিশ্লেষণ করেন না। অর্থনৈতিক তথা আর্থ-সামাজিক এবং যৌন বিজ্ঞানের নব নব আবিস্কারগুলির ধারে কাছেও যান না।

বুদ্ধিজীবীরা কেউ সমাজতত্ত্ব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন, কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে, কেউ জীবন বিজ্ঞান নিয়ে, কেউ মনস্তত্ত্ব নিয়ে, কেউবা আইন কানুন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন। সমাজের জন্য প্রয়োজনীয়, মানুষের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত দিকগুলি নিয়ে একসঙ্গে বিচার বিশ্লেষণের জন্য, সমস্ত ধরণের তত্ত্বকে নিয়ে সামঞ্জস্যপুর্ণ কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে আজকের বুদ্ধিজীবীরা অপারগ। এর কারণ মুখ্যত সমাজের শ্রম-বিভাজন। জ্ঞান অর্জন পুঁজিবাদী সমাজে সর্বদাই বিভাজিত। পুঁজিবাদের স্বাভাবিক নিয়মেই জ্ঞান অর্জনের পেছনে পেশাদারিত্ব ক্রিয়াশীল। পেশাদারী উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জ্ঞান অর্জনের ফলে, জীবনের মানবিক দিকগুলি, বিষয় কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা সমাধান সূত্রের পথ খুঁজে পায়না।
উপরন্তু, চাপিয়ে দেয়া পুঁজিবাদী দর্শনের যাঁতাকলে, মানবিক চিন্তার বিকাশ ঘটানোর পথও অবরুদ্ধ। এমতাবস্থায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সমাজতত্ত্ব নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের বেশিরভাগ অংশই কোন ভূমিকা নিতে পারছেন না। পরিবার প্রথার বিশ্লেষণে, সমাজ বিবর্তনের ধারাটিকে বিশ্লেষণ না করতে পারলে, অর্থাৎ অতীতের পরিবার প্রথার রূপগুলোকে বিশ্লেষণ না করতে পারলে, বর্তমানের অত্যন্ত প্রকট ‘একপতিপত্নী’ পরিবারও ভবিষ্যতে আদৌ টিকে থাকবে কিনা, তা নিয়ে ধারণা করা যাবেনা। তা হলে প্রথমেই ‘একপতিপত্নী’ প্রথার পূর্ববর্তি রূপগুলি নিয়ে আলোচনা করতে হয়।

পরিবার প্রথার প্রথম স্তরটি ছিল ‘একরক্ত সম্পর্কের পরিবার’। তখন বিবাহের দলগুলি পুরুষানুক্রমে নির্ধারিত হত। ঐ প্রথায় পরিবারের গণ্ডির মধ্যে সমস্ত ঠাকুর্দা ও ঠাকুমারা পরস্পরের স্বামী-স্ত্রী, তাদের সন্তানেরা অর্থাৎ বাপেদের ও মায়েদের সম্পর্কও ঠিক তেমনি চলে আসত। তাদের ছেলেমেয়েরা তৃতীয় পর্যায়ে, আর প্রথমোক্তদের প্রপৌত্র প্রপৌত্রীরা চতুর্থ পর্যায়ের স্বামী-স্ত্রী । এই স্তরে, উত্তর পুরুষের সঙ্গে পুর্ব পুরুষের, পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তান সন্ততির বিবাহ সম্পর্কের প্রথা ছিলনা। ভাইয়েরা ও বোনেরা , সমস্ত মামাত, জেঠতুত, মাসতুত, পিসতুত ভাই ও বোনেরা যাহেতু পরস্পরের ভাই ও বোন, ঠিক এই জন্যেই তারা পরস্পরের স্বামী ও স্ত্রী হত। একজোড়া স্ত্রীপুরুষের বংশধরদের নিয়েই গঠিত হত এই পরিবার। পিতামাতার সাথে যৌন সম্পর্ক রহিত হয়েই এই পরিবারের উৎপত্তি হয়।

পরবর্তিকালে ভাই বোনের মধ্যে যৌন সম্পর্ক রহিত করার প্রয়োজন দেখা দিল । আর তখনই পরিবার প্রথা পুনর্গঠনের দ্বিতীয় পদক্ষেপটি দেখা দিল সমাজের পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে। এই পদক্ষেপটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খুব ধীরে এই পরিবর্তন ঘটে। প্রথমে আপন ভাইবনেদের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ হয়, পরে কাজিনদের মধ্যেও বিয়ে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। অন্তর্প্রজনন তখনই শেষ হয়ে যায় গোত্র প্রথার বিকাশের সাথে সাথে।

ভ্রাতা ও ভগিনীর মধ্যে যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ করে, যে নূতন পরিবার প্রথার উদ্ভব হয়, তাকে সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেন পুনুলুয়া পরিবার। এখানে সহোদরা অথবা সমান্তরবর্তি কয়েকজন ভগিনী হত তাদের সাধারণ স্বামীদের সাধারণ স্ত্রী। কিন্তু তাদের ভাইয়েরা বাদ পড়ত। এটাই হচ্ছে পরিবার গঠনের চিরায়ত রূপ, পরে যার অনেক রকম পরিবর্তন হয়। এর একটি অপরিহার্য মূল বৈশিষ্ঠ হচ্ছে, একটি নির্দিষ্ট পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে একদল পুরুষ ও একদল স্ত্রীর যৌথ পারিবারিক সম্পর্ক। ভিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে স্বাধীন ভাবেই এই প্রথাগুলোর উৎপত্তি হয় সমাজের বিকাশের সাথে সাথে, উৎপাদন ব্যবস্থার অগ্রগতির সাথে সাথে। এখনও কোন কোন আদিম জনগোষ্ঠীতে এই ধরণের পরিবারের রূপ দেখতে পাওয়া যায়।

পুনুলুয়া পরিবার প্রথাটিকে পেছনে ফেলে যে পরিবার প্রথা পরবর্তি ধাপে দেখা দেয়, তা হচ্ছে ‘জোড়াবাধা’ পরিবার। বর্বর অবস্থায় এই ‘জোড়াবাধা’ পরিবার প্রথাটি গড়ে উঠেছিল ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা থেকেই। উৎপাদন ব্যবস্থার আরও অগ্রগতির সাথে সাথেই এই পরিবার গঠনের তাগিদ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু তখনো মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। সেখানে কিন্তু সন্তানদের উপর মায়েদেরই অধিকার থাকত।

উৎপাদন ব্যবস্থার চূড়ান্ত অগ্রগতির কারণে, এই পরিবার প্রথাও টিকলো না। তখন সমাজে দেখা দিল দুটি পরিবর্তন। এক ক্রীতদাস প্রথা আর দুই নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য। একদল মানুষ চলে এল একদল মানুষের অধীনে, নারীরা চলে গেল পুরুষের অধীনে।

‘জোড়াবাধা’ পরিবার প্রথার সময়েই জানা গেল, সন্তান উৎপাদনে পুরুষেরও ভূমিকা আছে। আর তখনই সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রশ্নে, সন্তানের পরিচয় নিশ্চিন্ত করতে, নারীদের আরও বিশেষভাবে বন্দিনী করার প্রয়োজনের তাগিদে, নিখুঁত এক-বিবাহের প্রয়োজন দেখা দিল। কিন্তু সেটা একমাত্র নারীর ক্ষেত্রে, পুরুষের ক্ষেত্রে নয়। কারণ সন্তানের চিহ্নিতকরণ তখনই সম্ভব, যখন নারী একজন মাত্র পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্ক রাখবে। কিন্তু পুরুষের লাম্পট্যে কোনও অসুবিধা দেখা দিল না। একাধিক স্ত্রী রাখার ব্যবস্থা পাকাপাকি ভাবে সমাজে স্থান নিল। তারপরে এক বিবাহের আরও পরিবর্তন ঘটতে ঘটতে তা ‘একপতিপত্নী’ প্রথায় এসে উপস্থিত হল। এখন সেই ‘একপতিপত্নী’ প্রথার বিশিষ্ট রূপটিই প্রকট যদিও বিভিন্ন আদিম জনগোষ্ঠীতে পুরাতন বৈবাহিক সম্পর্কগুলোও দেখা যায়।

এবার যে প্রশ্নটা সামনে চলে আসছে, তা হল এই ‘একপতিপত্নী’ প্রথার ভবিষ্যৎ কি। এটা সর্বজনবিদিত যে, এই ‘একপতিপত্নী’ প্রথাও ভাঙ্গনের মুখে। এখনি দেখা যাচ্ছে, কথায় কথায় ডিভোর্স, লিভ টুগেদার, নারী নর্যাতন, নারীর পিতৃ গৃহ থেকে উৎখাত। ভ্রুণ অবস্থায় সন্তান

হত্যা, জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতির অসাধারণ অগ্রগতি ইত্যাদি। এমনকি মাতৃ গর্ভও এখন ভাড়া পাওয়া যায়। আর সন্তানের সংখ্যা একজনে নেমে এসেছে, ফলে অদূর ভবিষ্যতে আত্মীয় বলতে মা, বাবা, দাদু, দিদিমা, ঠাকুর্দা আর ঠাকুমায় এসে ঠেকে যাবে। ভাই, বোন, মামা, মাসী, কাকা, জেঠা এসব আত্মীয় গল্পের বইয়ের বিষয় হয়ে উঠবে। ইতিহাস হয়ে থাকবে।

আমেরিকায় ৭০ শতাংশ বাবা সন্তান নিয়ে একাকী বাস করছে। সন্তান প্রতিপালনের প্রবণতা সেখানে বাবার দিকেই ঝুঁকছে। বিদেশের কথা ছেড়েই দিলাম, ভারতেও মাতৃগর্ভ এখন ভাড়া পাওয়া যায়। মাতৃগর্ভও এখন পণ্য। আমেরিকান পত্র-পত্রিকা ফলাও করে জানাচ্ছে ওখানকার মহিলারা এখন নাকি আর বাচ্চা পাওয়ার জন্য পাগল নন। আমদের এখানে তো একটাতে এসে দাঁড়িয়েছে। সন্তান প্রতিপালনের ঝুট-ঝামেলা তরুণীরা আর মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। অনাগত ডিভোর্সের ভয়েও বাচ্চা অনেকেই চান না, কি হবে একটা বাচ্চার যদি ডিভোর্স হয়ে যায়। নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক সমীক্ষার খবরঃ ‘ক্রমশ যুক্তরাষ্ট্রে ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ছে। বিবাহিতাদের ৫১ শতাংশ এখন আর ঘর বাধেন না। ১৯৫০ সালে এই সংখ্যাটা ছিল ৩৫ শতাংশ। স্বামীস্ত্রী একত্রে বসবাস করার সংখ্যা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। এ.এফ.পির খবর অনুযায়ী, মহিলারাই স্বাধীনভাবে একা বসবাসের পক্ষপাতি। সেন্সাস রিপোর্ট বলছে, কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের কেবল ৩০ শতাংশ স্বামীর সাথে ঘর করেন। হিসপানিক মহিলাদের ৪৯ শতাংশ, আর অ-হিসপানিক শ্বেতাঙ্গ মহিলাদের ৫৫ শতাংশই পৃথকভাবে বসবাস করেন। এশিয়া গোষ্ঠীভুক্ত মার্কিনি মহিলাদের ৬০ শতাংশ মহিলা রয়েছেন স্বাধীনভাবে।

এখন স্পষ্টতই এই ‘একপতিপত্নী’ প্রথাও ভাঙ্গনের মুখে। ভবিষ্যতে, যদি এই ‘একপতিপত্নী’ পরিবার প্রথা সমাজের প্রয়োজন পূরনের উপযোগী না হয়, তাহলে এর যায়গায় কী আসবে তার প্রকৃতি সম্বন্ধে কোনও ভবিষ্যৎ বাণী এখনই করা যায়না। তবে এতটুকুই বলা যায়, ইতিহাসের পর্যালোচনা থেকে এটাই সিদ্ধান্তে আসতে হয় যে, এই ‘একপতিপত্নী’ প্রথাও শেষ হয়ে যাবে সমাজের পরিবর্তনের সাথে সাথে।


2 কমেন্টস্:

তন্ময় কর্মকার বলেছেন...

দাদা, সংগ্রহে রাখবার মতো তথ্য বহুল লেখা।

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় বলেছেন...

পরিশ্রমী লেখা , এবং সুখপাঠ্য ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন